শেখ সাইফুল ইসলাম কবির
“জাগো সাংবাদিক জাগো — বজ্রকণ্ঠে আওয়াজ তুলুন — আর নয় কোনো সাংবাদিক নির্যাতন — এখনই সময় সাংবাদিক নির্যাতনের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ান।”
এই মন্ত্রে শুরু করি। কারণ, আজকের এই প্রেক্ষাপটে এই মন্ত্রই আমাদের একমাত্র মঞ্চ, একমাত্র প্রতিরোধ, একমাত্র উত্তূরণ।
বাংলাদেশের গণমাধ্যম—সংবাদপত্র, অনলাইন নিউজ, টিভি, রেডিও—এসবই দেশের তথ্যপ্রবাহ ও সচেতনতার রক্তনালিকা। সাংবাদিকেরা হলেন সেই রক্তবাহী জাহাজের যাত্রী ও চালক, যারা দুঃসাহস হাতে নিয়েছেন সত্যের খোঁজ, দুর্নীতির বিরুদ্ধে আওয়াজ, জবাবে মানুষের অধিকার। কিন্তু সেই সাংবাদিকরা আজ নীরব হতে বাধ্য হচ্ছেন — নির্যাতন, হয়রানি ও আইনগত উৎকণ্ঠার ভয়ে।
এই আটিকালে আমরা বিশ্লেষণ করব:
1. সাংবাদিক নির্যাতন ও হয়রানি — বর্তমান বাস্তবতা
2. নিয়ন্ত্রণ, বাধা ও আইনগত বাধা
3. সাংবাদিক সুরক্ষা ও দাবিসমূহ
4. আমাদের করণীয় — আন্দোলন, প্রতিরোধ, জাগরণ
5. উপসংহার — এই সংগ্রামের আহ্বান
১. সাংবাদিক নির্যাতন ও হয়রানি — বর্তমান বাস্তবতা
বাংলাদেশে সাংবাদিক নির্যাতনের ধরণ দিন দিন বাড়ছে। আক্রমণ, মামলা, হুমকি, গ্রেফতার, সাংবাদিকতার স্বীকৃতি বাতিল — এগুলো এখন সাধারণ হয়ে উঠেছে।
হামলা ও শারীরিক নির্যাতন
সাংবাদিকরা সংবাদ সংগ্রহ করতে গিয়ে হামলার শিকার হচ্ছেন। ২০২৪ ও ২০২৫ সাল ধরলে, আগস্ট ২০২৪ থেকে মার্চ ২০২৫ সময়ে অন্তত ৩৯৮টি হামলা ও হয়রানির ঘটনা নথিভুক্ত করেছে স্বাধীন অধিকারসংগঠন Ain O Salish Kendra (ASK)।
কতো সাংবাদিক শহর বা জেলা পর্যায়ে, রাজনৈতিক বা অর্থনৈতিক প্রভাবশালী গোষ্ঠীর বিরুদ্ধে অনুসন্ধান করতে গিয়ে মারধর, লাঞ্ছন, অপমান সহ ভয়ভীতি দেখিয়ে কাজ করতে বাধ্য হচ্ছেন।
অভ্যন্তরীণ সূত্র মতে, সাময়িক সরকার প্রথম আট মাসেই ৬৪০ জন সাংবাদিককে টার্গেট করেছে — অভিযোগ, অনুমান ও হামলাসহ বিভিন্ন আক্রমণমূলক দণ্ডবিধি প্রয়োগ করা হয়েছে।
মামলা, গ্রেফতার ও আইনগত উৎকণ্ঠা
সাংবাদিকদের বিরুদ্ধে বিভিন্ন ধরনের মামলা দায়ের করা হয়েছে — তথ্যপ্রবাহ, ‘অশ্লীল’ লেখা, ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন বা সংশ্লিষ্ট ধারায় অভিযোগ।
অনেকে হয়রানি লক্ষ্য করে গ্রেফতার হয়েছেন বা মামলায় অভিযুক্ত হয়েছেন, যদিও তারা শুধু সাংবাদিকতা করছিলেন।
একাধিক সাংবাদিকের প্রেস এক্রেডিটেশন বাতিল করা হয়েছে, যা তাদের সরকারি অনুষ্ঠান বা প্রতিষ্ঠানে সংবাদক্রিয়া—প্রেস ব্রিফিং, মন্ত্রণালয়ে প্রবেশ ইত্যাদিতে বাধা দিচ্ছে।
প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ দমন
কেবল শারীরিক নয়, মানসিক ও অর্থনৈতিক চাপে সাংবাদিকদের নিশ্চল করা হচ্ছে।
ভয়ভীতি ও হুমকি
চাকরি অথবা মিডিয়া হাউস থেকে বরখাস্ত
সংবাদ প্রকাশ বাধা
সেন্সরশিপ ও আত্মসংশয়
দেশের বিভিন্ন সংবাদপত্র ও অনলাইন প্ল্যাটফর্মে সাংবাদিক ছাঁটাই হয়েছে, মিডিয়া বন্ধ হয়েছে বা বাধাপ্রাপ্ত হয়েছে।
বরগুনা, বরিশাল, চট্টগ্রাম ইত্যাদিতে সাংবাদিকদের ওপর হামলা, প্রবেশ বাধার ঘটনাও ঘটেছে।
ফলাফল ও অবস্থা
এই নির্যাতন ও দমন নিম্নলিখিত সমস্যাগুলি ঘটাচ্ছে:
সাংবাদিকদের আত্মসংশয় ও আত্মসংযম
গুরুত্বপূর্ন সংবাদ — দুর্নীতি, বিশ্লেষণাত্মক তদন্ত — প্রকাশ পায় না
জনগণ তথ্যপ্রবাহ থেকে অবহিত থাকে না
গণতান্ত্রিক চেতনা বিঘ্নিত হয়
সাংবাদিক পেশার প্রতি আস্থা কমে যায়
সংবিধানে সংবাদমাধ্যমকে “চতুর্থ স্তম্ভ” বলা হয়েছে, তবে বাস্তবতায় সেই স্তম্ভ অনেকটাই কাটা প্রায়।
২. নিয়ন্ত্রণ, বাধা ও আইনগত বাধা
নির্যাতনের এই প্রবাহের পেছনে রয়েছে নানা ধরনের নিয়ন্ত্রণ এবং বাধা — আইনগত, প্রশাসনিক ও মধ্যস্ততাকারী উপায়।
ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন ও সংশ্লিষ্ট আইন
বাংলাদেশে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন (Digital Security Act) দীর্ঘদিন থেকেই সংবাদ ও মতপ্রকাশের স্বাধীনতার সবচেয়ে বড় বাধা। হুমকি, অপপ্রচার, মিথ্যাচার ইত্যাদি দৃষ্টিকোণ থেকে তার অনুচিত প্রয়োগ নিন্দিত।
এই আইন “ভয়, বাধা ও দোষপ্রমাণের বিপরীতে” সাংবাদিকদের কাজকর্মকে কঠিন করে তুলেছে।
অনেক সাংবাদিক বলা হয়েছে “তথ্য বিভ্রাট” বা “অশ্লীলতা” ধারায় মামলা করে তাদের দমন করা হয়েছে।
প্রশাসনিক বাধা
– প্রাথমিক বৈধতা ও এক্রেডিটেশন বাতিল করা (প্রেস এক্রেডিটেশন বন্ধ করা)
– সরকারি/অর্ধ-সরকারি প্রতিষ্ঠানে সাংবাদিকদের প্রবেশ বাধা
– মন্ত্রণালয় প্রজ্ঞাপন বা নীতিমালা অনুযায়ী বাধা দেওয়া
– অনৈতিকভাবে সাংবাদিক নিয়োগ বা ছাঁটাই
– অর্থায়ন ও বিজ্ঞাপন বরাদ্দে রাজনৈতিক প্রভাব
মিডিয়া মালিকানার ও কর্পোরেট চাপ
কিছু মিডিয়াহাউসে রাজনৈতিক বা অর্থনৈতিক প্রভাবে সাংবাদিকদের স্বাধীনতা হঠাৎ কমে আসে।
মালিকপক্ষ রাজনৈতিক চাপ নিয়ে আসে, সাংবাদিকদের নিয়ন্ত্রণ করে বা নীতি-আচরণ বাধ্য করে।
এছাড়া একাধিক মিডিয়া সংলগ্ন কর্পোরেট গোষ্ঠীও সৃজনশীল স্বাধীনতা কমিয়ে দিচ্ছে।
স্ব-সংশয় ও আত্মসংশয়
এই কঠোর পরিবেশে অনেক সাংবাদিক—বিশেষ করে প্রান্তিক অঞ্চলে—স্বয়ং-সংশয়ে পড়ে যান।
“এই প্রতিবেদনে আমাকে বিপদ হতে পারে”, “আমি কি ভুল বলব না?” — এই ভয়বোধ তাদের কাজকে সীমাবদ্ধ করে দেয়।
এভাবে, অত্যাচার যতই প্রবল হোক না কেন, স্বস্ফূর্ত প্রতিবাদ কমে আসে।
৩. সাংবাদিক সুরক্ষা ও দাবিসমূহ
এই হামলে প্রতিরোধ ও প্রতিক্রিয়া গড়ে ওঠার জন্য সাংবাদিক সমাজ ও নাগরিকদের কয়েকটি মৌলিক দাবি ও সুরক্ষা ব্যবস্থা থাকা আবশ্যক।
আইনগত সুরক্ষা
1. সাংবাদিক সুরক্ষা আইন প্রণয়ন
সাংবাদিকরা যদি নির্যাতিত হন, তাহলে দ্রুত, অবিচারবিহীনভাবে অভিযুক্তদের বিচার হবে — এ ধরনের বিশেষ আইন জরুরি। যুগান্তরসহ সাংবাদিক সংগঠন ইতিমধ্যেই দাবি তুলেছে।
2. ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন সংস্কার বা বাতিল
ওই আইনকে আন্তর্জাতিক মানবাধিকার মানদণ্ডের সঙ্গে সঙ্গতিপূর্ণ করে সংশোধন করতে হবে।
3. প্রক্রিয়াগত স্বচ্ছতা ও তদারকি ব্যবস্থা
নির্যাতন বা হয়রানি ঘটলে স্বনিরপেক্ষ তদন্ত কমিটি গঠন করতে হবে, দ্রুত অভিযোগ নিষ্পত্তি হতে হবে।
4. সাংবাদিক এক্রেডিটেশন ও স্বীকৃতি নীতিমালা
নির্ধারিত নীতিমালার ভিত্তিতে এক্রেডিটেশন দেওয়া হবে, রাজনৈতিক হস্তক্ষেপ থেকে মুক্ত থাকতে হবে।
5. সাংবাদিক নিয়োগ নীতিমালা ও খাতায় নাম অন্তর্ভুক্তি
কোন সাংবাদিককে চটকে বাদ দেওয়া যাবে না। নিয়মিত ও নির্ধারিত পদ্ধতিতে সাংবাদিকদের তালিকা ও আইডি থাকা দরকার।
6. আর্থিক ও বীমা সুরক্ষা
সাংবাদিকদের জন্য দুর্ঘটনা, চিকিত্সা, আইনগত সহায়তা ও পরিবারবিমার ব্যবস্থা থাকতে হবে।
সামাজিক ও সংগঠিত সুরক্ষা
সাংবাদিক সমিতি, ইউনিয়ন ও সমবায় সংগঠন গড়ে উঠবে — একতা, সংহতি
নির্যাতনের শিকার সাংবাদিকদের জন্য জরুরি হেল্পলাইন ও সহায়ক নেটওয়ার্ক
মানসিক, আইনগত ও চিকিৎসাসুবিধা প্রদান
মিডিয়া সংস্থায় শৃঙ্খলাপূর্ণ স্ব-নিয়ন্ত্রণ ও সাংবাদিক নৈতিকতা বলবৎ থাকা
সচেতনতামূলক উদ্যোগ
সাংবাদিক স্বাধীনতা ও নিরাপত্তা বিষয়ে জনজাগরণ
শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে, বিশ্ববিদ্যালয়ে, মঞ্চে আলোচনা
আন্তর্জাতিক গণমাধ্যম ও মানবাধিকার সংস্থার সঙ্গে সংযোগ ও তথ্য বিনিময়
“সাংবাদিক নির্যাতন বন্ধ করুন” শ্লোগান ও প্রচার অভিযানে গণমানুষকে যুক্ত করা
৪. আমাদের করণীয় — আন্দোলন, প্রতিরোধ, জাগরণ
সাহস ছাড়া এই যুদ্ধ জেতা সম্ভব নয়। সাংবাদিকরা, সাংবাদিক-সমর্থকরা, ও সাধারণ জনগণ — সবাইকে একসাথে সামনে আসতে হবে।
সংগঠিত আন্দোলন
– নির্যাতন, মামলা, হামলা প্রতিরোধে সাংবাদিকরা সমাবেশ, মানববন্ধন, সংবাদিক কলম বিরতি বা সংবাদ “নির্ঘোষ কার্যক্রম” করতে পারেন। ইতিমধ্যে একটি “কলম বিরতি” ঘোষণা করা হয়েছে।
– সাংবাদিক সংস্থা, ইউনিয়ন, ফেডারেশন দেশের নানা কোণ থেকে সাধারণ জনসমক্ষে মুক্ত আলোচনা আয়োজন করতে পারেন।
– আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সংস্থা, সাংবাদিক অভ্যন্তরীণ গোষ্ঠীর সঙ্গে রিলেশন গড়ে তোলা — তাদের মনোযোগ আকৃষ্ট করা।
– সৌজন্য প্রতিবাদ — যেমন সংবাদপ্রতিষ্ঠান বন্ধ রাখা, বিশেষ প্রতিবাদ প্রতিবেদনে বিশিষ্ট খবর প্রচার না করা ইত্যাদি।
আইনী প্রতিরোধ
– নির্যাতনের শিকার সাংবাদিকদের দ্রুত মামলা কিংবা মামলা প্রত্যাহারের সমর্থন দেওয়া
– আইনজীবী ও মানবাধিকার সংস্থা সমর্থন
– সাংবাদিকদের আইনি প্রশিক্ষণ ও সচেতনতা বাড়ানো — ‘কবে মামলা হতে পারে’, ‘কোন নিয়ম মেনে চলতে হবে’ ইত্যাদি
– দ্রুত অভিযোগ দায়ের, আদালতে নিরপেক্ষ বিচার দাবি
জনমত ও সামাজিক অংশগ্রহণ
– সাধারণ মানুষকে (পাড়া-মহল্লা, স্কুল, মাদ্রাসা, কলেজ) সাংবাদিকদের অবস্থা বোঝানো
– সামাজিক মিডিয়ায় “#সাংবাদিকনির্যাতনবিরোধে_জাগো” ধরণের প্রচারণা
– প্রতিবাদ পত্র, অ্যাল্টারনেটিভ মিডিয়া, ব্লগ, ফেসবুক পোস্ট, টুইটার টুইট — সকল জায়গা ব্যবহার
– শিক্ষার্থীদের, তরুণ প্রজন্মকে স্বায়ত্তশাসন, সংবাদচেষ্টা ও সাংবাদিকতার মূল্যবোধ শেখানো
দৃঢ় মনোভাব ও ঐক্য
– সাংবাদিকদের একতা অটুট রাখতে হবে — দলমত, পন্থাক্রমে বিভাজন নয়
– সহকর্মীর প্রতি সংহতি, সাহস এবং মানসিক সমর্থন
– ভয়বোধ দুর করে, নির্যাতনের বিরুদ্ধে দাঁড়ানো — এই মনোবল লাগবে
– দীর্ঘমেয়াদী সংগ্রাম — আজকের ছোট সফলতা বড় পরিবর্তন আনতে পারে
৫. উপসংহার — এই সংগ্রামের আহ্বান
সাংবাদিক নির্যাতন, দমন ও নিষ্ক্রিয়তা — এগুলো শুধু সাংবাদিকদের বিড়ম্বনা নয়, গণতন্ত্র, তথ্যপ্রাপ্যতা ও মানুষের অধিকার হরণ।
“এবারের সংগ্রাম — আমাদের সাংবাদিক নির্যাতনের সংগ্রাম।” এই স্লোগান শুধু প্রতিবাদ নয়, এটি আমাদের প্রতিজ্ঞা: নীরব থাকব না, লজ্জিত থাকব না, দাঁড়াব — সত্যের পক্ষে, ন্যায্যতার পক্ষে।
> “জাগো সাংবাদিক জাগো — বজ্রকণ্ঠে আওয়াজ তুলুন — আর নয় কোনো সাংবাদিক নির্যাতন — এখনই সময় সাংবাদিক নির্যাতনের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ান।”
শেখ সাইফুল ইসলাম কবির চেয়ারম্যান জাতীয় মফস্বল সাংবাদিক ফোরাম কেন্দ্রিয় কমিটি ঢাকা।