শেখ সাইফুল ইসলাম কবির
সাংবাদিকতা একটি মহান পেশা। এটি সমাজের দর্পণ, গণতন্ত্রের চতুর্থ স্তম্ভ, এবং সাধারণ মানুষের কণ্ঠস্বর। তবে এই মহান পেশার সঙ্গে যুক্ত মানুষদের বাস্তবতা সবসময় গৌরবজনক নয়—বিশেষ করে মফস্বলের সাংবাদিকদের কথা বললে, চিত্রটি অনেক বেশি বেদনাদায়ক ও করুণ। এখানে সাংবাদিকতার আদর্শ, নীতিমালা, পেশাগত সম্মান—সবই আজ প্রশ্নবিদ্ধ। সাংবাদিকদের মধ্যেই তৈরি হয়েছে বিভেদ, দলাদলি ও স্বার্থপরতা। আর তার ফলেই আজ মফস্বলের সাংবাদিকরা নিজেদের ন্যায্য অধিকার থেকে বঞ্চিত, অসহায় এবং অস্তিত্ব সংকটে ভুগছেন।
মফস্বলের সাংবাদিকদের বাস্তবতা
বাংলাদেশের অধিকাংশ উপজেলা ও মফস্বল এলাকায় সাংবাদিকতা করতে গিয়ে বহু প্রতিবন্ধকতার মুখোমুখি হতে হয়। মূলধারার মিডিয়াগুলোর সিংহভাগ কভারেজ রাজধানীকেন্দ্রিক হলেও, স্থানীয় পর্যায়ের সাংবাদিকরাই প্রকৃত মাঠপর্যায়ের খবরে জীবনের ঝুঁকি নিয়ে কাজ করেন। কিন্তু দুর্ভাগ্যজনকভাবে, সেই পরিশ্রমের ন্যায্য মূল্য বা সম্মান তারা পান না।
অনেক জায়গায় দেখা যায়, একজন সাংবাদিক দিনের পর দিন নিরলস কাজ করেও শুধু নামমাত্র একটি ‘আইডি কার্ড’ আর ‘অস্থায়ী প্রতিনিধিত্ব’ ছাড়া কিছুই পান না। নেই নির্ধারিত সম্মানী, নেই প্রশিক্ষণ বা নিরাপত্তা। অনেকেই খরচ নিজের পকেট থেকেই চালান, সংবাদ প্রেরণ করেন নিজের ফোনে, নিজের ডেটা কিনে। অথচ, তাদের কাজের গুরুত্ব একটুও কম নয়—বরং অনেক সময় জাতীয় গণমাধ্যম তাদের পাঠানো খবরে ভর করেই বড় প্রতিবেদন তৈরি করে।
—
সাংবাদিকদের ভেতরের বিভাজন
এই পেশার সবচেয়ে বড় দুর্বলতা হলো—সাংবাদিকদের মধ্যকার ভেদাভেদ, হিংসা ও দলাদলি। মফস্বলের সাংবাদিক সমাজে কিছু ব্যক্তি আছেন যারা নিজেদের প্রভাব-প্রতিপত্তি বজায় রাখতে চান যেকোনো মূল্যে। তারা চান না সাংবাদিক সমাজ ঐক্যবদ্ধ হোক, উন্নত হোক, বা কারো প্রভাব বৃদ্ধি পাক। তাই তারা নানা কৌশলে অন্যদের দমন করে রাখেন।
কখনো প্রতিষ্ঠানিক স্বীকৃতি দিতে গড়িমসি করা হয়, কখনো সিনিয়র-জুনিয়রের নামে বিভাজন সৃষ্টি করা হয়, আবার কখনো বিভিন্ন সংগঠনের ব্যানারে নিজেদের ‘গডফাদার’ বানানোর প্রবণতা চলে। যারা প্রতিবাদ করেন বা ন্যায়ের কথা বলেন, তারা হয় উপেক্ষিত হন, নয়তো হুমকি পান।
—
পেশাগত নিরাপত্তাহীনতা ও হয়রানি
আজকের দিনে একজন মফস্বল সাংবাদিক শুধু পেশাগত বঞ্চনার শিকার নন, বরং তিনি নিজেই একেকটি ঝুঁকিপূর্ণ জীবন বয়ে বেড়াচ্ছেন। অনেক সময় প্রশাসনের নির্যাতন, রাজনৈতিক চাপে চুপ থাকা, বা প্রভাবশালীদের রোষানলে পড়ে সাংবাদিকদের জেলে যেতে হয়, মামলা-মোকদ্দমার শিকার হতে হয়। আবার সমাজের অনেকেই সাংবাদিকদের সন্দেহের চোখে দেখে। কেউ কেউ বলে—“আপনারা শুধু চাঁদাবাজি করেন” কিংবা “সব সাংবাদিক এক—টাকার জন্য যা খুশি লেখেন।”
এই মানসিক অবমূল্যায়নের কারণ কিন্তু অনেকাংশে আমাদের ভেতরের কিছু মানুষের আচরণ। যারা সংবাদপত্রকে ব্যবসা বা ব্যক্তিগত প্রভাব খাটানোর হাতিয়ার বানিয়েছেন, তারাই গোটা সমাজে সাংবাদিকতার ভাবমূর্তি ধ্বংস করছেন।
—
নৈতিক অবক্ষয়ের দায় কার?
মফস্বলের সাংবাদিক সমাজে যেসব সংকট চলছে, তার দায় কার? শুধুই প্রশাসনের? শুধুই রাজনৈতিক চক্রান্তের? না কি আমাদের ভেতরের কিছু লোভী, সুবিধাবাদী মানুষের?
আমরা দেখতে পাই, কিছু ‘সাংবাদিক নেতা’ আছেন, যারা সাংবাদিকতার আদর্শ বা মুক্ত মতপ্রকাশে বিশ্বাসী নন। তারা চান নিজেদের দলবল নিয়ে ক্ষমতা ধরে রাখতে। কারো পদোন্নতি বা প্রতিনিধিত্ব হলে তাকে ঠেকিয়ে দেওয়া হয়, কৌশলে বিভ্রান্তি ছড়ানো হয়, এমনকি ভয়ভীতি দেখানো হয়। এই চর্চা সাংবাদিক সমাজে বৈষম্য তৈরি করছে, বিভেদ বাড়াচ্ছে এবং নতুনদের নিরুৎসাহিত করছে।
—
ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতার প্রতিফলন
একজন সাংবাদিক হিসেবে আমি ব্যক্তিগতভাবে অনেক সময় কষ্ট পেয়েছি। কেউ গালমন্দ করেছে, কেউ অপমান করেছে, কেউ বলেছে—“তুই খারাপ মানুষ, তাই এসব সহ্য করিস।” আমি হয়তো সহ্য করতে পারি, কারণ আমি মানসিকভাবে প্রস্তুত। কিন্তু প্রশ্ন থেকে যায়—যারা সুনামধন্য, নির্লোভ, বড় মাপের সাংবাদিক, তারা কীভাবে এসব সহ্য করছেন? তাদের তো সামনে এগিয়ে এসে প্রতিবাদ করার কথা, নেতৃত্ব দেওয়ার কথা!
যদি এই সৎ, দক্ষ এবং অভিজ্ঞ সাংবাদিকরাই নীরব থাকেন, তবে পরিবর্তন আসবে কোথা থেকে? তরুণরা শিখবে কীভাবে? সাংবাদিকতা কি তবে কিছু সুবিধাবাদীর হাতে বন্দী হয়ে থাকবে?
—
সম্ভাবনা ও করণীয়
সমস্যা যেমন রয়েছে, তেমনি রয়েছে সম্ভাবনা। মফস্বলের সাংবাদিকতার সংকট নিরসনে আমাদের কিছু পদক্ষেপ নিতে হবে—
1. ঐক্য গড়ে তোলা:
ব্যক্তিগত মতানৈক্য ভুলে সবাইকে একটি প্ল্যাটফর্মে আসতে হবে। ছোট-বড়, সিনিয়র-জুনিয়র ভেদাভেদ ভুলে সাংবাদিকদের স্বার্থে ঐক্যবদ্ধ হতে হবে।
2. পেশাগত প্রশিক্ষণ ও নৈতিকতা:
নিয়মিত প্রশিক্ষণ, কর্মশালা এবং সংবেদনশীলতা বৃদ্ধি করতে হবে। সাংবাদিকদের মধ্যে দায়িত্ববোধ, সততা ও পেশাদারিত্ব গড়ে তুলতে হবে।
3. সংগঠন সংস্কার:
যেসব সাংবাদিক সংগঠন নিজেদের ব্যক্তিস্বার্থে পরিচালিত হচ্ছে, সেগুলো সংস্কার করতে হবে। নেতৃত্বে আনতে হবে দক্ষ ও নিরপেক্ষ মানুষ।
4. নিরাপত্তা ও স্বীকৃতি নিশ্চিত করা:
সরকারের উচিত মফস্বলের সাংবাদিকদের জন্য নিরাপত্তা ও ন্যায্য স্বীকৃতি নিশ্চিত করা। আইনি সহায়তা, নির্যাতনের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা এবং প্রণোদনার ব্যবস্থা থাকা জরুরি।
5. ভিত্তিমূল সাংবাদিকতা ফিরিয়ে আনা:
গুজব, হুমকি, ব্যক্তিগত আক্রোশ নয়—সত্য, তথ্য ও জনস্বার্থে ভিত্তি করে সাংবাদিকতা করতে হবে। জনসচেতনতা তৈরি করতে হবে সাংবাদিকতার গুরুত্ব নিয়ে।
—
উপসংহার
মফস্বলের সাংবাদিকতা আজ এক সন্ধিক্ষণে দাঁড়িয়ে আছে। একদিকে রয়েছে নিঃস্বার্থ পরিশ্রমী কিছু মানুষ, যারা সমাজ বদলাতে চান। অন্যদিকে, রয়েছে সুযোগসন্ধানী কিছু লোক, যারা নিজেদের প্রভাব-প্রতিপত্তির জন্য অন্যদের দাবিয়ে রাখেন। এই দ্বন্দ্বের মাঝে পড়ে আজ সাংবাদিকতার আদর্শ ধ্বংসের মুখে।
এই পরিস্থিতি চলতে থাকলে, সাংবাদিকতা শুধু পেশাগত মর্যাদা হারাবে না—বরং হারাবে সমাজের আস্থা। এখন সময় এসেছে বদলানোর। সৎ, সাহসী, নিরপেক্ষ সাংবাদিকদের একত্রিত হতে হবে। নিজেরাই নিজেদের অধিকার রক্ষায় সোচ্চার হতে হবে। আর না হলে, আমাদের ভবিষ্যৎ প্রজন্ম শুধু অতীতের গৌরবগাথা শুনে আফসোস করবে—যেখানে একসময় সাংবাদিকরা সমাজ বদলের অগ্রনায়ক ছিলেন।
শেখ সাইফুল ইসলাম কবির চেয়ারম্যান জাতীয় মফস্বল সাংবাদিক ফোরাম কেন্দ্রিয় কমিটি ঢাকা।