মাহফুজুর রহমান মোর্শেদ
আলীকদম প্রতিনিধি-
পার্বত্য বান্দরবান জেলা সদরে ২১ শে অক্টোবর ২০২৫ খ্রিস্টাব্দ বিকাল০৩:০০ঘটিকার সময় "পার্বত্য চট্টগ্রামে খ্রিস্টানাইজেশন বন্ধের দাবিতে পার্বত্য চট্টগ্রাম নাগরিক পরিষদ -পিসিএনপি -কর্তৃক বান্দরবানের হোটেল ডিফোর ঘেরাও এবং বান্দরবান জেলা সদরে পিসিএনপি ও নাগরিক সমাজের প্রতিবাদ সমাবেশ অনুষ্ঠিত হয়।
উক্ত হোটেল ঘেরাও ও সমাবেশে- বক্তব্য রাখেন -
পার্বত্য চট্টগ্রাম নাগরিক পরিষদ (পিসিএনপি) কেন্দ্রীয় সভাপতি কাজী মুজিবুর রহমান ও মানবাধিকার কর্মী ও সাংবাদিক এম রুহুল আমিন জানান পার্বত্য চট্টগ্রামের দীর্ঘ সময়ের ইতিহাসের নানা ঘটনার পরিক্রমায় এটা স্পষ্ট যে, ব্রিটিশ আমল থেকেই বাংলাদেশের তিন পার্বত্য জেলা এবং এর সংলগ্ন মায়ানমারের কিছু পার্বত্য এলাকা ও ভারতের ‘সেভেন সিস্টার’ খ্যাত রাজ্যগুলোর সমন্বয়ে খ্রিস্টান অধ্যুষিত একটি স্বাধীন রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার পরিকল্পনা ছিল।
পশ্চিমাদের এই কল্পিত রাষ্ট্র বঙ্গোপসাগরের তীর থেকে শুরু করে চীনের সীমানা পর্যন্ত বিস্তৃত। এ কারণেই এই অঞ্চলে বসবাসরত পাহাড়ি জনগোষ্ঠীগুলোকে স্থানীয় সমতলবাসীদের থেকে সুপরিকল্পিতভাবে বিচ্ছিন্ন রেখে মিশনারিদের দ্বারা খ্রিস্টান বানানোর প্রক্রিয়া শুরু হয়েছিল বহু আগে থেকেই।
১৯০০ সালে ব্রিটিশরা যে হিল ট্র্যাক্টস রেগুলেশন অ্যাক্টের মাধ্যমে পাহাড়ি জনগণকে স্থানীয় বাঙালি জনগণ থেকে বিচ্ছন্নকরণ করে তার মূলেও ছিল তাদের সেই পরিকল্পিত রাষ্ট্র গঠনের ইচ্ছা। এটা করা হয়েছিল মূলত স্থানীয় বাঙালিদের থেকে পাহাড়িদের বিচ্ছিন্ন রেখে তাদেরকে খ্রিস্টান ধর্মে দীক্ষিত করা সহজ হবে এই আকাক্সক্ষায়। কিন্তু প্রথম দিকে খ্রিস্টান ধর্মে ধর্মান্তকরণ প্রক্রিয়ায় ছিল ধীর গতি। তাই ব্রিটিশরা তাদের এই কল্পিত রাষ্ট্রের দ্রুত এবং সফল বাস্তবায়নের জন্য ১৯৪৭ সালে উপমহাদেশ ছেড়ে যাওয়ার সময়েও এই অঞ্চলটিকে ভারত কিংবা পাকিস্তান কারও অধীনেই না রাখার পক্ষপাতি ছিল। তাদের ধারণা ছিল যে, এই অঞ্চলটি ভারত কিংবা পাকিস্তানের অংশ না হলে এখানকার স্থানীয় জনগোষ্ঠীগুলোর পক্ষে সফল এবং কার্যকর রাষ্ট্র ব্যবস্থা গঠন সম্ভব হবে না। এই সুযোগে ব্রিটিশরাই আবার ত্রাণকর্তা হিসেবে হাজির হয়ে নিজেদের পরিকল্পনা বাস্তবায়নকে তরান্বিত করতে পারবে। যাই হোক, সে সময় তাদের পরিকল্পনা বাস্তবায়ন না হলেও তারা যে থেমে নেই সেটাই এখন দৃশ্যমান। সেই পরিকল্পনা বাস্তবায়নে তারা যে তৎপর তা তাদের কর্মকাণ্ড দেখলেই বোঝা যায়। কারণ একদিকে তারা যেমন স্থানীয় পাহাড়ি জনগোষ্ঠীগুলোকে খ্রিস্টান বানাতে উঠেপড়ে লেগেছে, তেমনি তারা এসব জনগণকে বাঙালি মুসলমান, বাংলাদেশ সরকার এবং সেনাবাহিনী বিদ্বেষী করে তুলছে।
একই সাথে ‘আদিবাসী’ কনসেপ্ট, ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র জনগোষ্ঠীগুলোকে স্থানীয় সর্বাধিক প্রচলিত ভাষার পরিবর্তে মাতৃভাষায় শিক্ষিত করার কনসেপ্ট দিয়ে রাষ্ট্র এবং স্থানীয় জনগণ থেকে তাদের বিচ্ছিন্ন রাখার মিশন বাস্তবায়ন করছে। অন্যদিকে যেসব জনগোষ্ঠীর বর্ণমালা নেই তাদের ভাষাকে রোমান হরফে লেখার প্রচলন করা হচ্ছে, যাতে এসব জনগোষ্ঠীর যোগাযোগটা সংশ্লিষ্ট রাষ্ট্র এবং তার জনগণের সাথে না হয়ে পশ্চিমাদের সাথেই ঘনিষ্ঠ হয়, বিশেষ করে যারা রোমান হরফ ব্যবহার করে তাদের সঙ্গে হয়। পশ্চিমাদের আশীর্বাদপুষ্ট মিশনারিদের এই অপতৎপরতা যে শুধু বাংলাদেশের তিন পার্বত্য জেলায় সীমিত তা কিন্তু নয়, একই মিশন নিয়ে তারা কাজ করছে মায়ানমার এবং ভারতের সংশ্লিষ্ট রাজ্যগুলোতেও-
একই সাথে তারা এসব অঞ্চলের জনগণের মধ্যে আন্তঃযোগাযোগ বাড়ানোর চেষ্টাও করছে। ভিন্ন দেশের সীমানায় বসবাস করছে একই জনগোষ্ঠীর লোকজনদের ক্ষেত্রে তাদেরকে বিশেষ বিশেষ সংগঠনের আওতায় সংগঠিত করা হচ্ছে। বাংলাদেশ এবং ভারতের বিভিন্ন রাজ্যে বসবাসরত চাকমা এবং ত্রিপুরাদেরকে সমন্বিত করে ইতোমধ্যে একাধিক সংগঠন প্রতিষ্ঠা করা হয়েছে বলে শোনা যাচ্ছে। অপরদিকে এসব অঞ্চলে যেসব মিশনারিরা তৎপরতা চালাচ্ছে তারাও দুর্গম ও অরক্ষিত সীমান্ত দিয়ে ভিসা-পাসপোর্ট ছাড়াই এক দেশ থেকে অন্য দেশে যাতায়াত করে তাদের মধ্যে আন্তঃযোগাযোগ প্রতিষ্ঠা করছে।
একবার মায়ানমার থেকে এভাবে কয়েকজন মিশনারি বান্দরবানে প্রবেশের ঘটনা জানাজানি হয়ে যাওয়ায় বেশ তোলপাড় হয়েছিল। কিন্তু দুর্গম অঞ্চলের সীমান্ত অরক্ষিত থাকায় সব খবর তো প্রশাসনের পক্ষে রাখাও সম্ভব না, তাই এমন ঘটনা হরহামেশায় ঘটলেও অবাক হওয়ার কিছু থাকবে না। বাংলাদেশের পার্বত্য চট্টগ্রাম এবং তার সংলগ্ন মায়ানমার ও ভারতের রাজ্যগুলোর এ চিত্রকে পূর্বতিমুর এবং দক্ষিণ সুদানের ইতিহাস এবং ঘটনা চিত্রের সাথে মিলিয়ে দেখলে, আশা করি সম্ভাব্য পরিণতি সম্পর্কে আর কাউকে বুঝিয়ে বলতে হবে না।
বাংলাদেশের পার্বত্য চট্টগ্রামে অপ্রতিরুদ্ধ খ্রিস্টান মিশনারিরা এবং খ্রিস্টানাইজেশন শুধু বাঙালি মুসলমান এবং বাংলাদেশের সমস্যা এটা ভাবলে বোকামি হবে। হ্যাঁ, বাঙালি মুসলমান এবং বাংলাদেশের জন্য এটা একটা বিরাট সমস্যা; তবে এ সমস্যা থেকে রেহাই পাবে না ভারত, মায়ানমার; এমনকি চীনের জন্যও এটা আতঙ্কজনক একটি বার্তা। ধারণা করা যায়, ভারত শুরুতে এটাকে শুধু বাংলাদেশের সমস্যা মনে করেছিল। তাই তারা এটাকে আরও উস্কে দেওয়ার জন্য পার্বত্য চট্টগ্রামের উগ্রপন্থী সশস্ত্র সংগঠনগুলোকে আশ্রয়, অস্ত্র, ট্রেনিং দিয়ে পরিস্থিতি অস্থিতিশীল করে রেখেছিল। কিন্তু এতে তাদের হিতে বিপরীত হয়েছে। বাংলাদেশের চাকমা প্রাধান্য বিশিষ্ট সশস্ত্র সংগঠন শান্তিবাহিনীকে তাদের দেশের আশ্রয় দেয়ার ফলে সেদেশের চাকমাদের সাথে এদের যোগাযোগ বৃদ্ধি পেয়েছে। গড়ে উঠেছে যৌথ সংগঠন, যাদের দৃশ্যমান লক্ষ্য আন্তঃসাংস্কৃতিক যোগাযোগ বাড়ানোহ হলেও, তাদের ভবিষ্যৎ এবং মূল লক্ষ্য হলো একটি বৃহত্তর স্বাধীন চাকমা ল্যান্ড প্রতিষ্ঠা করা। ভারত সরকার বিষয়টি বুঝতে পেরেই ১৯৯৭ সালে তড়িঘড়ি করে বাংলাদেশ সরকারের সঙ্গে একটি অসমচুক্তি করিয়ে দিয়ে এই চাকমাদের ভারত থেকে তাড়িয়েছে। কিন্তু একবার যে যোগাযোগ প্রতিষ্ঠা হয়েছে, তা চাইলেই নিঃশেষ করে দেয়া যায় না। এ ক্ষেত্রেও তাই হয়েছে। দুই দেশের চাকমাদের মধ্যে বিভিন্ন উপলক্ষে যোগাযোগ এখন নিত্যনৈমিত্তিক ঘটনা হয়ে দাঁড়িয়েছে, যা দুই দেশের সরকারেরই জানা আছে। অন্যদিকে এমএন লারমা চীন সফর করে এসে শান্তবাহিনী প্রতিষ্ঠা করেছিল বলে চীন এদের প্রশ্রয় দিয়েছে অথবা এদের অপকীর্তির ব্যাপারে নীরব ভূমিকা পালন করেছে। কিন্তু বর্তমানে যে হারে এই অঞ্চলের উপজাতীয় জনগণ খ্রিস্টান হচ্ছে তা থামানো না গেলে ভারত কিংবা চীনের জন্যও তা মাথাব্যথার কারণ হতে বাধ্য। কারণ এই অঞ্চল খ্রিস্টান প্রধান অঞ্চলে পরিণত হলে এদের যোগাযোগ ভারত কিংবা চীনের পরিবর্তে পশ্চিমাদের সাথেই বেশি ঘনিষ্ঠ হবে। আর সেটা হলে বর্তমান বিশ্বের উদীয়মান সুপার পাওয়ার চীন এবং ভারতের জন্য তা অস্বস্তির কারণ হতে বাধ্য। আর বর্তমানে মায়ানমারের যেসব বৌদ্ধরা মুসলিমদের হত্যা করে উল্লাস করছে তাদের জন্য অশনি সঙ্কেত হয়ে আসবে এই খ্রিস্টানরাই। একই সাথে বাংলাদেশের পার্বত্যাঞ্চলে যেসব বৌদ্ধ পণ্ডিতরা বর্তমানে বিভিন্ন স্থানে বড় বড় কিংয়াং বানিয়ে জায়গা দখলে ব্যস্ত আছেন, আর কয়েক দশক পরে তারা তাদের এসব মন্দিরের সেবা করার জন্য কোনো পূজারি পাবেন কিনা তাতেই সন্দেহ আছে।
অতএব, পার্বত্য চট্টগ্রামে অপ্রতিরুদ্ধ খ্রিস্টান মিশনারিরা এবং খ্রিস্টানাইজেশন সমস্যা শুধু বাংলাদেশের সমস্যা নয়। এটা মায়ানমার, ভারত এবং চীনের অখ-তা ও নিরাপত্তার জন্যও হুমকিস্বরূপ। সর্বোপরি এখানে বৌদ্ধ ধর্মের অস্তিত্ব বিলুপ্তির কারণও হতে পারে এটা। তাই পারস্পারিক সহযোগিতা বৃদ্ধি করে এই সমস্যাকে যৌথভাবে মোকাবিলা করতে হবে। সংশ্লিষ্ট সকলকেই ড় হবে, ইউরোপীয় ইউনিয়নের পক্ষ থেকে বাঙালিমুক্ত পার্বত্য চট্টগ্রাম গড়ার প্রেসক্রিপশনের অন্তর্নিহিত অর্থ কী। কেনই বা তারা বাঙালিদের জন্য সকল প্রকার রাষ্ট্রীয় সুযোগ-সুবিধা বন্ধ করে দেয়ার পরামর্শ দেয়? কেনই বা তারা ‘আদিবাসী’ কনসেপ্ট নিয়ে এত মাতামাতি করে, রাষ্ট্রকে অনৈতিক চাপ প্রয়োগ করে তা বাস্তবায়ন করতে চায়?
পার্বত্য চট্টগ্রাম নাগরিক পরিষদ পিসিএনপি কেন্দ্রীয় সভাপতি কাজী মুজিবুর রহমান ও মানবাধিকার কর্মী ও সাংবাদিক এম রুহুল আমিন জানান অশান্ত পাহাড়ে শান্তি, সম্প্রীতি ও উন্নয়নের ধারাবাহিকতা বজায় রাখা জন্য প্রলোভনের মাধ্যমে খৃষ্টান ধর্মান্তর প্রক্রিয়া বন্ধ করতে হবে। তাই সরকার কে দায়িত্ব পালন করতে হবে।