শেখ সাইফুল ইসলাম কবির
তথ্য একটি রাষ্ট্রের উন্নয়ন ও গণতান্ত্রিক কাঠামোকে টিকিয়ে রাখার অন্যতম প্রধান উপাদান। তথ্যের অবাধ প্রবাহ ও জনগণের তথ্য জানার অধিকার শুধু সচেতনতা বাড়ায় না, বরং জবাবদিহিতামূলক প্রশাসন গঠনে সহায়তা করে। এই অধিকারকে স্বীকৃতি দিয়ে প্রতি বছর ২৮ সেপ্টেম্বর পালন করা হয় আন্তর্জাতিক তথ্য জানার অধিকার দিবস (International Day for Universal Access to Information)। এই দিবসটি শুধু সাধারণ জনগণের নয়, বিশেষ করে সাংবাদিকদের জন্য অত্যন্ত তাৎপর্যপূর্ণ। কারণ সাংবাদিকরা গণতন্ত্রের চতুর্থ স্তম্ভ হিসেবে কাজ করেন, আর তাঁদের কাজের অন্যতম প্রধান শক্তি হলো তথ্য।
এই প্রবন্ধে আমরা আলোচনা করব—আন্তর্জাতিক তথ্য জানার অধিকার দিবসের ইতিহাস, সাংবাদিকদের জন্য এর সুবিধা, বাস্তবতায় তাঁদের অবস্থান, রাষ্ট্রের দায়িত্ব ও ভবিষ্যতের করণীয় সম্পর্কে।
—
তথ্য জানার অধিকার দিবসের সংক্ষিপ্ত ইতিহাস
তথ্য জানার অধিকারের গুরুত্ব বহু বছর ধরেই স্বীকৃত হলেও, একে আন্তর্জাতিকভাবে স্বীকৃতি দেওয়ার উদ্যোগ শুরু হয় ২০০২ সালে, যখন বুলগেরিয়ার রাজধানী সোফিয়াতে প্রথমবারের মতো এই দিনটি ‘রাইট টু নো’ নামে পালন করা হয়। পরে ২০১৫ সালে ইউনেস্কোর ৩৮তম সাধারণ সম্মেলনে ২৮ সেপ্টেম্বরকে আনুষ্ঠানিকভাবে “আন্তর্জাতিক সার্বজনীন তথ্য জানার অধিকার দিবস” হিসেবে ঘোষণা করা হয়। এরপর ২০১৯ সালে জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদের ৭৪তম অধিবেশনে এটি “International Day for Universal Access to Information” হিসেবে স্বীকৃতি পায়।
—
তথ্য জানার অধিকার: একটি মৌলিক মানবাধিকার
জাতিসংঘের মানবাধিকার সনদ অনুযায়ী, তথ্য জানার অধিকার একটি মৌলিক অধিকার। তথ্য জানার সুযোগ না থাকলে নাগরিকরা কখনোই সরকারের কার্যক্রম সম্পর্কে সচেতন হতে পারে না এবং প্রশাসনের জবাবদিহিতা নিশ্চিত করা সম্ভব হয় না। বিভিন্ন দেশেই এখন তথ্য জানার অধিকার আইন প্রণয়ন করা হয়েছে। বাংলাদেশে ২০০৯ সালে তথ্য অধিকার আইন (Right to Information Act) পাস হয়।
—
সাংবাদিকদের জন্য তথ্য জানার অধিকার: আশীর্বাদ না চ্যালেঞ্জ?
তথ্য জানার অধিকার শুধু একটি আইন নয়—এটি সাংবাদিকদের জন্য একটি শক্তিশালী হাতিয়ার। কারণ:
১. তথ্য সংগ্রহের সহজতা
সাংবাদিকদের জন্য নির্ভরযোগ্য তথ্য সংগ্রহ একটি মৌলিক কাজ। এই আইনের মাধ্যমে তারা সরকারি ও বেসরকারি প্রতিষ্ঠান থেকে নির্দিষ্ট সময়সীমার মধ্যে তথ্য পেতে পারেন, যা তাঁদের অনুসন্ধানী রিপোর্ট তৈরিতে সহায়তা করে।
২. দুর্নীতিবিরোধী কার্যক্রমে সহায়তা
তথ্য জানার সুযোগ থাকলে সাংবাদিকরা বিভিন্ন দুর্নীতি, অনিয়ম ও অপশাসনের ঘটনা তুলে ধরতে পারেন। এটি প্রশাসনে স্বচ্ছতা আনয়ন করে এবং জনগণের আস্থা বৃদ্ধি করে।
৩. গণমাধ্যমের স্বাধীনতা নিশ্চিত
তথ্যের অবাধ প্রবাহ সংবাদপত্র ও ইলেকট্রনিক মিডিয়ার স্বাধীনতা বৃদ্ধি করে। এতে অনুসন্ধানী সাংবাদিকতা বিকাশ লাভ করে, যা একটি গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রে অপরিহার্য।
৪. জনগণের কাছে সঠিক তথ্য পৌঁছানো
একজন সাংবাদিক যখন নির্ভরযোগ্য সূত্র থেকে তথ্য পান, তখন তিনি জনগণকে বিভ্রান্তিমূলক তথ্যের বদলে বাস্তব চিত্র তুলে ধরতে সক্ষম হন। এটি সমাজে সচেতনতা বৃদ্ধির পাশাপাশি গুজব প্রতিরোধেও সহায়তা করে।
—
বাস্তবতার চিত্র: কতটা লাভবান সাংবাদিকরা?
তথ্য জানার অধিকার আইন কার্যকর থাকা সত্ত্বেও, সাংবাদিকদের বাস্তবে নানা প্রতিবন্ধকতার সম্মুখীন হতে হয়। যেমন:
১. প্রশাসনিক জটিলতা
অনেক সরকারি-বেসরকারি প্রতিষ্ঠান তথ্য প্রদানে অনীহা প্রকাশ করে বা বিলম্ব করে, ফলে সাংবাদিকদের সময়মতো প্রতিবেদন তৈরি করা কঠিন হয়ে পড়ে।
২. হয়রানি ও ভীতি প্রদর্শন
তথ্য চাওয়ার কারণে অনেক সময় সাংবাদিকদের বিরুদ্ধে মিথ্যা মামলা, আইনি চাপ, এমনকি হুমকি পর্যন্ত দেওয়া হয়। অনেকে মারধর, নির্যাতন বা হত্যার শিকার হন।
৩. রাজনৈতিক চাপ ও সেন্সরশিপ
বিশেষ করে রাজনৈতিকভাবে সংবেদনশীল তথ্য সংগ্রহ বা প্রকাশের সময় সাংবাদিকদের সেন্সরশিপের মুখে পড়তে হয়, যা স্বাধীন সাংবাদিকতার পথে বড় অন্তরায়।
৪. সীমিত প্রশিক্ষণ ও অবকাঠামোগত সমস্যা
প্রান্তিক সাংবাদিকদের অনেকে তথ্য অধিকার আইন সম্পর্কে পর্যাপ্ত প্রশিক্ষণ পান না। পাশাপাশি প্রযুক্তিগত সহায়তার অভাব তাঁদের তথ্য সংগ্রহের পথে বাধা তৈরি করে।
—
রাষ্ট্রের দায়িত্ব: কী করণীয়?
সাংবাদিকদের জন্য তথ্য জানার অধিকার বাস্তবায়নে রাষ্ট্রের কিছু গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ নেওয়া প্রয়োজন:
১. আইনের কার্যকর প্রয়োগ
তথ্য অধিকার আইন যেন কাগজে-কলমে সীমাবদ্ধ না থাকে, সে জন্য প্রশাসনের প্রতিটি স্তরে এর প্রয়োগ নিশ্চিত করতে হবে।
২. সাংবাদিকদের নিরাপত্তা বিধান
তথ্য প্রকাশের কারণে কোনো সাংবাদিক যেন হয়রানি বা সহিংসতার শিকার না হন, সে জন্য যথাযথ নিরাপত্তা নিশ্চিত করা জরুরি।
৩. তথ্যপ্রদান ব্যবস্থার উন্নয়ন
তথ্য কর্মকর্তা নিয়োগ ও তাদের প্রশিক্ষণ নিশ্চিত করতে হবে যাতে তারা সঠিকভাবে ও সময়মতো তথ্য প্রদান করতে পারেন।
৪. তথ্যপ্রযুক্তির ব্যবহার
ডিজিটাল পোর্টাল, ওপেন ডেটা ইনিশিয়েটিভের মাধ্যমে তথ্য সংগ্রহ আরও সহজ করা যেতে পারে। এতে সাংবাদিকদের পাশাপাশি সাধারণ নাগরিকরাও উপকৃত হবেন।
৫. জনসচেতনতা বৃদ্ধি
সাধারণ মানুষ ও মিডিয়া কর্মীদের মধ্যে তথ্য অধিকার আইন সম্পর্কে সচেতনতা বাড়াতে প্রশিক্ষণ ও ক্যাম্পেইনের উদ্যোগ নেওয়া উচিত।
—
আন্তর্জাতিক প্রেক্ষাপট: অন্যান্য দেশের অভিজ্ঞতা
বিভিন্ন দেশে তথ্য জানার অধিকার আইন অত্যন্ত কার্যকরভাবে ব্যবহার হচ্ছে। যেমন:
সুইডেন: ১৭৬৬ সালেই তারা তথ্যের অধিকার আইন প্রণয়ন করেছে, যা বিশ্বের প্রথম।
ভারত: ২০০৫ সালের আইন অনুসারে তথ্য চাওয়া ও না দেওয়া গেলে আপিলের সুযোগ রয়েছে। সাংবাদিকরা এটি অত্যন্ত কার্যকরভাবে ব্যবহার করেন।
মেক্সিকো ও দক্ষিণ আফ্রিকা: এসব দেশে তথ্য জানার অধিকার আইন অত্যন্ত শক্তিশালী এবং সাংবাদিকদের জন্য উন্মুক্ত।
বাংলাদেশেও এই অভিজ্ঞতাগুলো অনুসরণ করে তথ্য জানার অধিকারকে আরও শক্তিশালী করা সম্ভব।
—
ভবিষ্যৎ চ্যালেঞ্জ ও করণীয়
বিশ্ব এখন তথ্যযুদ্ধের যুগে প্রবেশ করেছে। ভুয়া সংবাদ, মিথ্যা প্রচার এবং ভুল তথ্যের মাধ্যমে সমাজে বিভ্রান্তি ছড়ানো হচ্ছে। এই পরিস্থিতিতে সাংবাদিকদের জন্য তথ্য জানার অধিকার আরও গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠেছে।
তবে শুধুমাত্র আইন প্রণয়ন করলেই চলবে না। সাংবাদিকদের নিরাপদ, স্বাধীন ও উৎসাহব্যঞ্জক পরিবেশ নিশ্চিত করতে হবে। প্রয়োজনে তথ্য জানার প্রক্রিয়া ডিজিটাল করে আরও সহজ, দ্রুত ও স্বচ্ছ করতে হবে।
—
উপসংহার
তথ্য জানার অধিকার শুধু একটি আইন নয়, এটি একটি গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রের প্রাণ। এই অধিকার বাস্তবায়নের মাধ্যমে সাংবাদিকতা যেমন শক্তিশালী হয়, তেমনি জনগণও সচেতন ও সক্রিয় নাগরিক হিসেবে গড়ে ওঠে।
২৮ সেপ্টেম্বর আন্তর্জাতিক তথ্য জানার অধিকার দিবস কেবল একটি দিন নয়, এটি একটি আহ্বান—স্বচ্ছতা, জবাবদিহিতা ও সাংবাদিকতার স্বাধীনতা নিশ্চিত করার পথে একটি দৃঢ় পদক্ষেপ।
আমরা আশা করি, বাংলাদেশসহ বিশ্বজুড়ে রাষ্ট্রগুলো সাংবাদিকদের তথ্য জানার অধিকারকে সম্মান জানাবে, আইন বাস্তবায়নে আন্তরিক হবে এবং সংবাদমাধ্যমের স্বাধীনতা রক্ষা করবে। কারণ, তথ্যবিহীন গণতন্ত্র নিছকই এক ভ্রম।
—শেখ সাইফুল ইসলাম কবির চেয়ারম্যান জাতীয় মফস্বল সাংবাদিক ফোরাম কেন্দ্রিয়নকমিটি ঢাকা।